মুফতি জুবায়ের রশীদ:
তাহাজ্জুদ আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। নিবিড়তম উপায় ও পন্থা। যুগে যুগে যারাই তার মহান রবের সন্তুষ্টি ও অশেষ কৃপা লাভে ধন্য হয়েছেন তারা শেষ রাতের তাহাজ্জুদ নামাজকে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। দিবসের জনকোলাহল আর প্রকৃতির উল্লাস থেমে গিয়ে যখন পৃথিবী নীরব-নির্জন হয়ে পড়ে, রাত হতে থাকে গভীর থেকে গভীরতর, সেই হিরন্ময় প্রহরে বান্দা মেতে ওঠে স্রষ্টার ইবাদত-উপাসনায়। গাইতে থাকে তাঁর অপার শক্তিমত্তার জয়গান। নামাজে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করে রবের নিকটত্ব। জিকিরে দোয়া ও রোনাজারিতে কবুলিয়াতের অনন্ত ফরমান ও ঘোষণা নিয়ে আসে। প্রেম ও ভালোবাসার উচ্ছ্বাস উঠে আরশে আজিমে এবং প্রিয় বান্দার হৃদয়তটে। অশ্রুতে ভেসে যায় পাপের গ্লানি। অবাধ্যতার শেষ চিহ্ন। রুহানিয়াতের অফুরন্ত শক্তি ধারণ করে কলব ও আত্মায়। পৃথিবী ও খোদার আরশের দূরত্ব কমে আসে শেষ রাতে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অপেক্ষারত থাকেন বান্দার ডাকের। কখন বান্দা ডেকে বলবে ইয়া আল্লাহ…। হাদিসে তাহাজ্জুদের নামাজের গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে বিশদভাবে। সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ফরজ নামাজগুলোর পর উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ।’ (মুসনাদে আহমদ)। অন্য হাদিসে বর্ণিত আছেÑ রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন রাতের শেষ এক-তৃতীয়াংশ বাকি থাকে আমাদের রব পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন এবং ডাকতে থাকেন, আছে কি কেউ, আমার কাছে প্রার্থনা করবে অতঃপর আমি তার প্রার্থনায় সাড়া দেব। আছে কি কেউ, আমার কাছে কিছু চাইবে অতঃপর আমি তাকে তা দেব। আছে কি কেউ, আমার কাছে ক্ষমা চাইবে অতঃপর আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।’ (বোখারি, মুসলিম)।
প্রকৃতিতে এখন শীত। হিম হিম রাত। অগ্রহায়ণ যাই যাই করছে। চুপিচুপি আসছে শীত। রাতের বাতাসে দলা পাকিয়ে ভেসে ভেড়াচ্ছে কুয়াশা। রাত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। শীতের রাতই সবচেয়ে বড় হয়ে থাকে। পর্যাপ্ত ঘুমের চাহিদা মেটানোর পরও ঢের সময় বাকি থাকে রাত পোহানোর। ঘুমের চাহিদাও ফুরিয়ে আসে শেষ রাতের দিকে। তাই শীতের রাতকে আমলের রাত বানানোর এটা বিরাট মহোত্তম সুযোগ। তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করার সবচেয়ে বড় সুযোগ তৈরি হয় এই শীতে। সৌভাগ্য অর্জন করা যায় অতি সহজেই। লাভ করা যায় মহান মালিকের সান্নিধ্য। সাহাবি হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, ‘শীতকাল হচ্ছে মোমিনের বসন্তকাল। (মুসনাদে আহমাদ)। অপর বর্ণনায় রয়েছে, শীতের রাত দীর্ঘ হওয়ায় মোমিন রাত্রিকালীন নফল নামাজ আদায় করতে পারে এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখতে পারে। (সুনানে বায়হাকি)। সাহাবায়ে কেরাম ও তাদের পরবর্তী আল্লাহর প্রিয় বান্দারা শীতকালকে স্বাগত জানাতেন। শীতকালের আগমনে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলতেন, হে শীতকাল! তোমাকে স্বাগত! শীতকালে বরকত নাজিল হয়। শীতকালে রাত দীর্ঘ হওয়ায় নামাজ আদায় করা যায় এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখা যায়। প্রখ্যাত হজরত হাসান বসরি (রহ.) বলেন, শীতকাল মোমিনের জন্য কতই না উত্তম! রাত দীর্ঘ হওয়ায় নামাজ আদায় করা যায় এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখা যায়। তাই শীত হোক আমলের মৌসুম। হোক তাহাজ্জুদের ঋতু। বান্দা তার প্রভুর সৃষ্টি তার স্রষ্টার নিবিড় পরশে ধন্য হোক। গড়ে তুলুক সুন্দর আগামী। পুণ্যময় আখেরাত।
তাহাজ্জুদ ও অন্যান্য নামাজের সময়ও একটি বিষয় লক্ষ রাখা আবশ্যক যে, শীতকালে অজুর সময় অজুর অঙ্গগুলো ভালোভাবে ধৌত করা। অজুর কোনো অঙ্গ সামান্য পরিমাণ শুকনো থাকলে অজু হবে না। অজু না হলে ইবাদতও হবে না। প্রতিটি অঙ্গের যতটুকু স্থানে পানি পৌঁছানো দরকার, ততটুকু স্থানে পানি পৌঁছানো। শীতকালে অজুর অতিরিক্ত ফজিলত রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, তিনটি আমল পাপ মোচন করে, সংকটকালীন দান, গ্রীষ্মের রোজা ও শীতের অজু। (তাবরানি : ১৪১৪)। রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, আমি কি তোমাদের জানাব না, কীসে তোমাদের পাপ মোচন করবে? এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করবে? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, অবশ্যই! হে আল্লাহর রাসুল (সা.)। তিনি বললেন, শীতের কষ্ট সত্ত্বেও ঠিকভাবে অজু করা। (মুসলিম)।
শীতের দিনে আরও একটি বরকতময় ও গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো রোজা রাখা। হাদিসে শীতের দিনে রোজা রাখার কথা অধিক পরিমাণে আলোচিত হয়েছে। হজরত আমের ইবনে মাসউদ (রা.) নবীজি (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, শীতল গনিমত হচ্ছে শীতকালে রোজা রাখা। (তিরমিজি : ৭৯৫)। হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম খাত্তাবি (রহ.) বলেন, শীতল গনিমত মানে সহজলভ্য গনিমত। যেহেতু শীতের রোজায় রোজাদার গরমের তৃষ্ণা অনুভব করে না। মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) এর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে তাকে তার ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি বললেন, ‘আমি মৃত্যুর ভয়ে কাঁদছি না; বরং রোজার কারণে গ্রীষ্মের দুপুরের তৃষ্ণা, শীতের রাতের নফল নামাজ এবং ইলমের আসরগুলোতে হাজির হয়ে আলেমদের সোহবত হারানোর জন্য আমি কাঁদছি। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি তোমাদের শীতল গনিমত কি সেটা বলে দেব না? শ্রোতারা বললেন, অবশ্যই। তিনি বললেন, সেটা হচ্ছে শীতকালে দিনে রোজা রাখা ও রাতে নামাজ আদায় করা।